বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ। অসংখ্য প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দরিদ্র্যতা হ্রাস এবং মানব উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক দশকে বাংলাদেশ সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ সরকার দেশের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রশংসনীয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে নতুন মহাসড়ক নির্মাণ এবং বিদ্যমান মহাসড়কগুলোর প্রশস্তকরণ ও মানের উন্নয়ন। অনেক মসৃণ মাল্টিলেইন এক্সপ্রেসওয়ে বাংলাদেশে বিস্ময় সৃষ্টি করার মত বিষয় নয়। সড়ক উন্নয়ন দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ব্যাপক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে।
কিন্তু, সরকার মাল্টিলেইন চওড়া রাস্তা, রাজধানী ও বিভাগীয় শহর পরিকল্পনার ওপর অধিক গুরুত্ব দিলেও, ভূমি ব্যবহারের গ্রামীণ পরিকল্পনা সরকারের নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৮ অর্থবছর বেশ কিছু পৌরসভার শ্রেণি উন্নীতকরণের মাধ্যমে সেবার মান ও কাজের মান উন্নত হয়েছে। এমনকি ২৩৮টি পৌরসভার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ করা যায় না। প্রতিটি পৌরসভায় বাড়ি নির্মাণের প্রবণতা দেখলে ধারণা করা যায়, এলোমেলোভাবে নির্মিত হচ্ছে বাড়িগুলো, নেই সঠিক পরিকল্পনা। নাগরিক সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা ও খেলার মাঠ পৌরসভার কোনোটিতে নেই। তেমনি পৌরসভার বাইরে গ্রামীণ এলাকার জন্য পরিকল্পনা উল্লেখ না করলেই চলে।
যেহেতু এখন পর্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা নেই, সে কারণে নিজস্ব জমি থাকলে মানুষ যে কোনো স্থানে বাড়ি নির্মাণ করতে পারে। গ্রামের মানুষের একটি বিশেষ অভ্যাস হলো উর্বর কৃষিজমিতে বাড়ি নির্মাণের প্রবণতা। একটি পরিবারে দুটি সন্তান থাকলে দুটি বাড়ি নির্মাণ করে জমি নষ্ট করার প্রত্যয়। যার ফলে প্রতিদিন অনেক উর্বর জমি কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, নিম্ন প্লাবনভূমি বা খাল-বিলের পানিপ্রবাহের স্থানে বাড়ি নির্মাণের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় এলোমেলোভাবে বাড়িঘর নির্মাণের কারণে ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনগুলো গ্রামের বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলছে, স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করছে। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের ভূমি দিনদিন দুষ্প্রাপ্য সম্পদে পরিণত হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য কৃষিজমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং কৃষিজমি সংরক্ষণের পরিকল্পনা জরুরি। কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত জমি অত্যন্ত সীমিত সম্পদ, যা সহজে তৈরি বা প্রতিস্থাপন করা যায় না। একবার অন্য ব্যবহারে রূপান্তরিত হলে, কৃষি ও বনভূমিকে একটি উৎপাদনশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন।
গ্রামে এলোমেলো বাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি, দোকানপাটও গড়ে তোলা হচ্ছে কোনো সঠিক পরিকল্পনা এবং নিয়মকানুন তোয়াক্কা না করেই। অনেক সময় দেখা যায়, গ্রামের বাজারগুলোতে কোনো ফাঁকা জায়গা না রেখেই রাস্তার দুই পাশে ঘিঞ্জি ও লম্বা সারি সারি দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে দীর্ঘ পাকা প্রাচীর নির্মাণের ফলে বেশির ভাগ সময় রাস্তার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়, রাস্তার ওপর পানি জমে ও সাময়িক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে, বিটুমিনাসের রাস্তাগুলো দ্রুত ভেঙে যায়। অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত, গ্রামীণ এলাকার অনিয়ন্ত্রিত বাড়িঘর, দোকানপাট নির্মাণের ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। রাস্তার দুই পাশ দোকান দিয়ে ঘেরা থাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে পারে না। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিক্ষিপ্ত স্থানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করার জন্য রাস্তা বা বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়াও অনেক কঠিন ও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই দেখা যায় স্থায়ী খেলার মাঠ না থাকায় শিশু কিশোরদের ধানখেত বা সাময়িক পতিত জমিতে খেলাধুলা করতে। এসকল কারণে, গ্রামীণ এলাকার জন্য পারিসরিক ডিটেল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা খুবই জরুরি গুরুত্বপূর্ণ।
পারিসরিক ডিটেল ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা হলো একটি এলাকার প্রয়োজন ও ভূপ্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে সমন্বিত বিস্তারিত উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ ও নির্দেশনা প্রদান। যে কোনো পরিকল্পনার একটি অপরিহার্য অংশ হলো মানুষের সমান নাগরিক সুযোগ ও সুবিধা নিশ্চিত করা। পারিসরিক ডিটেল ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনা সাধারণত সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়নের পাশাপাশি, অবকাঠামোগত বিন্যাস ও স্থানভেদে ভূমিসম্পদের সুস্থ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য করা হয়। বেশির ভাগ সময় পরিকল্পনা সরকারি কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রণ এবং বাস্তবায়ন করা হয়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনার সময় একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে একটি এলাকাকে উপ-অঞ্চল বা বিষয়ভিত্তিক উন্নয়ন এলাকায় ভাগ করে, যা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সব ধরনের উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা এবং এমনকি বাড়ি নির্মাণের তদারকির জন্য গৃহীত হয়। জোন করা বিষয়ভিত্তিক উন্নয়নের এলাকাগুলো আইনের ভিত্তি প্রদান করে এবং সুশৃঙ্খল উন্নয়নের জন্য জমির সুনির্দিষ্ট ব্যবহার সংজ্ঞায়িত করে পরিবেশ রক্ষা করে, জীবিকার উন্নয়ন নিশ্চিত করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে, সামাজিক সংহতি এবং অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের ভারসাম্য বজায় রাখে।
ডিটেল ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনার প্রারম্ভিক ধাপ হলো ভূমিকে সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য শ্রেণিবিভাগ করা। তারপর, বিশেষজ্ঞ ও বাসিন্দাদের সম্মতিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভূমি ব্যবহার নির্ধারণ করা। উদাহরণস্বরূপ, ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনাকারীদের সাহায্যে, স্থানীয় লোকেরা নির্ধারণ করতে পারে যে গ্রামের কোথায় আবাসিক এলাকা নির্মাণ করা হবে, কোথায় গ্রামের বাজার ও বিদ্যালয় বা গ্রামের কত ভাগ রাস্তার জন্য রাখা উচিত। দেশের গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য ডিটেল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রক্রিয়া অবশ্যই টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক এবং চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হতে হবে। এই ধরনের পরিকল্পনা সুন্দরভাবে প্রণয়নের জন্য দূর অনুধাবন ও ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দূর অনুধাবন ও ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অতীতে ভূমির অবস্থা কেমন ছিল, বর্তমানে কেমন অবস্থায় আছে এবং ভবিষ্যতের ভূমি ব্যবহারের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে; বিকল্প পরিস্থিতি; ঝুঁকি নিরূপণ এ সহায়তা করবে।
তবে তাড়াহুড়া করে দেশের সব অঞ্চলকে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নির্বাচন না করে, বা কোনো কারণে সব জেলাতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব না হলে কয়েকটি ইউনিয়ন বা উপজেলাকে মডেল পরিকল্পনার স্থান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মডেল ডিটেল ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা থেকে শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যান্য অংশে পরিকল্পনা প্রণয়নে দারুণ সহায়ক হতে পারে। এটি দেশের গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পদ্ধতির নির্দেশনা দিতে পারে, যাতে কৃষিজমির ন্যূনতম ক্ষতি না করে ভূমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আগামী প্রজন্ম এবং বসবাসকারী মানুষের যেন আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। দেশের গ্রামগুলোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে-যদি আমরা সঠিক গ্রামীণ অঞ্চলের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে পারি। দেশের সব উর্বর কৃষি জমিকে অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় পরিণত করা থেকে বিরত রাখতে পারি।
লেখক: কবির উদ্দিন
ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ইসিমোড, নেপাল