সমন্বিত পর্বত উন্নয়নের আন্তর্জাতিক সংস্থা

বাংলাদেশ কী উপগ্রহচিত্র ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারে?

০১ মার্চ ২০২৪

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশ হিমালয়ের পাদদেশের দক্ষিণ ও বঙ্গোপসাগরের উত্তর অংশে অবস্থিত। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে সামান্য পাহাড়ি অঞ্চল হলেও পলল সমভূমি দ্বারা গঠিত বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদীনালা, বিল, হাওর-বাওড়, টিলা, পাহাড়, সমুদ্রসৈকত, বন, চা-বাগান, ইত্যাদি পরিবেশগত বৈচিত্র্য বহন করে। প্রভ‚ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার অন্যতম উল্লেখযোগ্য এবং সাফল্যের গল্পে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর জাতিতে পরিণত হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারার সঙ্গে সংগতি রেখে, কিছুটা হলেও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নমূলক কাজে ও দুর্যোগ মোকাবিলায় উপগ্রহের চিত্র ব্যবহার করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ বন বিভাগ ভূমি আবরণ ও ভূমি  ব্যবহার মানচিত্র প্রণয়ন, নতুন বনায়ন ও বন উজাড় এলাকা শনাক্তকরণ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যে দূর-অনুধাবন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। তেমনি স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর-অনুধাবন প্রতিষ্ঠান, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংসহ অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নানাবিধ কাজে উপগ্রহ চিত্র, দূর-অনুধাবন ও ভৌগালিক তথ্য ব্যবস্থাপদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। 

উল্লেখ্য যে, দূর-অনুধাবন প্রযুক্তি যুগের সূচনা হয়েছিল ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর, যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ, স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণ করেছিল। সেই মহাকাব্যিক মুহূর্ত থেকে এখন পর্যন্ত কৃত্রিম উপগ্রহ ও তার চিত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহের কোন শেষ নেই। কারণ পৃথিবী পর্যবেক্ষণে কৃত্রিম উপগ্রহ আইকনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি উভয়ই প্রদান করে আসছে। উপগ্রহ চিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো কোনো দূর-অনুধাবন বিশেষজ্ঞ ও পেশাদার মনে করেন, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ রেজুলেশনের উপগ্রহ ছবি ব্যবহার করা উচিত। অনেকেরই একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে যে, অতি উচ্চ-রেজুলেশনের বাণিজ্যিক চিত্র ক্রয় করে ব্যবহার করলেই মানচিত্রায়ণ নিখুঁত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং দেশের কল্যাণে মানচিত্র ব্যবহৃত হতে পারে। সাধারণ বাস্তবতা হলো, উপগ্রহচিত্রভিত্তিক ম্যাপিংয়ের কাজে এমন ধারণা অনেক সময় সঠিক নাও হতে পারে। উপগ্রহচিত্রভিত্তিক মানচিত্রায়ণের নির্ভুলতা উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। সেই সঙ্গে এটি উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণের সফটওয়্যারের ওপর অভিজ্ঞতার ও দূর-অনুধাবন চিত্র বিশ্লেষণের অ্যালগরিদম ব্যবহারের ওপরও নির্ভর করে। এক্ষেত্রে উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষক প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ হলে বিনামূল্যে সংগৃহীত উপগ্রহচিত্র দিয়ে ক্রয়কৃত উপগ্রহ চিত্রের প্রায় সমান মানের মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। 

এটা সত্যি যে, উচ্চ রেজুলেশন উপগ্রহচিত্রগুলো বেশি পরিষ্কার থাকায় খালি চোখে দেখা বা পর্যবেক্ষণমূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কিছু বেশি সুবিধা রয়েছে। তবে, অন্যদিকে উচ্চ রেজুলেশন উপগ্রহচিত্রগুলো ব্যবহার করার বিশেষ অসুবিধা হলো, সেগুলো ব্যয়বহুল, যেমন; প্রতি বর্গ কিলোমিটার ইমেজ ক্রয়ে আনুমানিক ১৫ মার্কিন ডলারের মতো খরচ হতে পারে।

ফলে, যে কোন মাস বা বছরের জন্য যত ইচ্ছা তত চিত্র ক্রয় বেশ অর্থসাপেক্ষ। বাণিজ্যিকভাবে যে কোন উপগ্রহচিত্র ক্রয়ের জন্য, অনেক ক্রয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ। উদাহরণস্বরূপ, ফসলের ধরন মানচিত্রায়ণের জন্য সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে উপগ্রহ চিত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে, তেমনি বন্যার সময় দ্রæত উপগ্রহ চিত্রের দরকার হয়। অত্যন্ত উচ্চ রেজুলেশন উপগ্রহচিত্র ফাইলের আকার অনেক বেশি, যে কারণে চিত্র বিশ্লেষণের জন্য উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটার প্রয়োজন। এছাড়া, যেহেতু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশির ভাগ উচ্চ রেজুলেশন উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। তাই উচ্চ রেজুলেশন উপগ্রহচিত্র অতীতের দীর্ঘমেয়াদি ভূমি ও গাছপালার পরিবর্তন দেখার জন্য উপযোগী নয়, বিশেষ করে ২০০০ সালের আগে তেমন কোনো মাল্টি-স্পেকট্রাল চিত্র আর্কাইভ নেই।

বিনামূল্যের উপগ্রহ চিত্রের আরেকটি সুবিধা হলো, যেকোন সময় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সংগ্রহ করা যায়। অতএব, যেসব প্রতিষ্ঠান উপগ্রহ চিত্রভিত্তিক মানচিত্র প্রণয়নে কাজ করে, এমন সংস্থাগুলো ওপরে উল্লিখিত বিনা মূল্যেও উপগ্রহচিত্রগুলো ব্যবহারের ব্যাপারে চিন্তা করতে পারেন। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নে নজর দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, দূর-অনুধাবন প্রতিষ্ঠানগুলো গুগল আর্থ-ইঞ্জিন ব্যবহার করে রিমোট-সেন্সিং ডেটা বিশ্লেষণে দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব আরোপ করতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন অধিদপ্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীদের জন্য দূর-অনুধাবন প্রশিক্ষণের ওপর আরো জোর দিতে পারেন। এছাড়াও, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগগুলো দেশি ও বিদেশি রিমোট সেন্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের  সাথে শিক্ষা ও গবেষণা সহযোগিতা বাড়াতে পারেন। মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনামূল্যে উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ করার সফটওয়্যারের ওপর গুরুত্ব দিতে পারেন।

যেমন, গুগল আর্থ-ইঞ্জিন একটি অনলাইনভিত্তিক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং সিস্টেম, যা ল্যান্ডস্যাট এবং সেন্টিনেল উপগ্রহসহ বিভিন্ন পেটাবাইট পরিমাণ বিনামূল্যের চিত্র অ-বাণিজ্যিক কাজে বিশ্লেষণ করার জন্য সুযোগ দিয়ে থাকে। এটি যেকোন ধরনের কম্পিউটার, এমনকি একটি মোবাইল ফোন ডিভাইস থেকে ব্রাউজারের মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা যায়। গুগল আর্থ-ইঞ্জিনের সবচেয়ে ভালো দিক হলো উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণের জন্য উচ্চক্ষমতার ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের প্রয়োজন পড়ে না, এমনকি ডেস্কটপ কম্পিউটারে ডাউনলোড করার প্রয়োজন পড়ে না।

বিশেষ কারণে কোন কোন প্রকল্পের প্রয়োজনে অতি উচ্চ রেজুলেশনের ছবি প্রয়োজন হয়, এক্ষেত্রে, অনুমতি সাপেক্ষে ড্রোন দিয়ে মাল্টি-স্পেকট্রাল চিত্র গ্রহণ করা যেতে পারে। ড্রোনের সুবিধা হলো একবার একটি ড্রোন ক্রয় করা হলে, সেই সংস্থা ড্রোনকে অনেক কাজে বহুবার ব্যবহার করতে পারেন। এতে প্রকল্পের অর্থ যেমন কম ব্যয় হবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

উল্লেখ্য যে, উপগ্রহচিত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে ১৯৭২ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূতাত্তি¡ক জরিপ/নাসা কর্তৃক উৎক্ষেপিত ল্যান্ডস্যাট উপগ্রহ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। এরপর থেকে পৃথিবীর চিত্রগ্রহণের জন্য বাণিজ্যিক এবং অ-বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো দ্বারা অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। তবে, ২০০৮ সালের শেষের দিকে বিশ্বব্যাপী সমস্ত ব্যবহারকারীর জন্য ল্যান্ডস্যাট উপগ্রহ চিত্রের বিনামূল্যে বিতরণের সিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যবহারের জন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। ২০১৪ সালে কোপার্নিকাস সেন্টিনেল উপগ্রহের উৎক্ষেপণ আরেকটি সুখবর নিয়ে এসেছিলো। কোপার্নিকাস হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের পৃথিবী পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি। প্রকল্পটি ইউরোপীয় কমিশনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর দ্য স্পেস প্রোগ্রাম দ্বারা ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা, ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বে সমন্বিত এবং পরিচালিত হয়। আকাশে উৎক্ষেপণ থেকে আজ পর্যন্ত কোপার্নিকাস সেন্টিনেল উপগ্রহচিত্র বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত এবং পরিবেশসংক্রান্ত  তথ্যসেবা বাস্তবায়নের জন্য কোপার্নিকাস হলো একটি ইউরোপীয় উদ্যোগ। কোপার্নিকাস সেন্টিনেল উপগ্রহ চিত্রগুলো নদীর গতিপথ পর্যবেক্ষণ, প্লাবনভূমির ম্যাপিং, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ, হিমবাহ, তুষার এবং ভূমি আবরণ ও ব্যবহার মানচিত্রায়ণ পরিবর্তনগুলো নির্ধারণ করার জন্য বিশেষভাবে কার্যকর।

সেই কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থাগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন ফসলের ধরন মানচিত্রায়ণ, বন ও অন্যান্য গাছপালার অবস্থার পর্যবেক্ষণ ও আচ্ছাদন পরিমাপসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা উদ্যোগের জন্য বিনামূল্যের উপগ্রহচিত্রগুলো ব্যবহার করতে পারে। সর্বোপরি, যেকোন ধরনের উপগ্রহচিত্রভিত্তিক কাজের পরিসর বাড়ানো ও প্রয়োগের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং গবেষণার কোন বিকল্প নেই।

লেখক:

কবির উদ্দিন, ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ
ইসিমোড, নেপাল

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram