সমন্বিত পর্বত উন্নয়নের আন্তর্জাতিক সংস্থা

ফ্লোরাল ট্যুরিজম বা ফুলভিত্তিক পর্যটন

১২ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের মানুষ ফুল ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি কতটা আন্তরিক, তা এখন আর অনুমানের বিষয় নয়। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্ল্যাটফরমগুলোতে একনজরেই তার ব্যাপক প্রতিফলন দেখা যায়। বসন্ত এলেই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকে ভাইরাল হয় তাহেরপুরের শিমুল বন, নেত্রকোনার পলাশ -জারুলে মোড়া পাহাড়ি পথ, কিংবা সংসদ ভবনের পেছনের কৃষ্ণচূড়ার নিচে তোলা সেলফি। এই মে মাসেও দেখা যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় জারুল ফুলের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে অনেকে তা অনলাইনে শেয়ার করছেন।

এই ডিজিটাল অভিব্যক্তি প্রমাণ করে, ফুলভিত্তিক ভ্রমণে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ গভীর এবং স্বতঃস্ফূর্ত। তারা শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করেন না, বরং তা ক্যামেরায় ধারণ করেন, অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেন এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখেন। এই আগ্রহকে যদি সুনির্দিষ্ট পর্যটন কাঠামোয় রূপ দেওয়া যায়, তাহলে এটি হয়ে উঠতে পারে একটি শক্তিশালী, পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিমূলক খাত ।

আমাদের দেশে ঋতুভিত্তিক ফুলের সমাহার এতটাই বৈচিত্র্যময় যে, প্রতিটি ঋতুকে ঘিরে একটি স্বতন্ত্র ফুলভিত্তিক পর্যটন ধারা গড়ে তোলা যেতে পারে। বসন্তে মধুপুর, দিনাজপুর কিংবা নেত্রকোনার বনভূমির ফাঁকা বা উজাড় স্থানে পলাশ, কাঞ্চন ও শিমুল ফুল ফুটিয়ে গোটা অঞ্চলকে রাঙানো যেতে পারে প্রকৃতির উৎসবে। গ্রীষ্মের খরতাপে শহর ও গ্রামকে রাঙাতে পারে কৃষ্ণচূড়ার লাল, সোনালুর হলুদ ও জারুলের বেগুনি মেলবন্ধন। বর্ষায় চরাঞ্চল ও নিচু ভূমিতে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছে ফুটে ওঠা সাদা ও গোলাপি ফুল এক মনোমুগ্ধকর জলরঙের দৃশ্য তৈরি করতে পারে ।

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল, চরাঞ্চল, হাওর ও গ্রামীণ রাস্তাঘাটে রয়েছে দেশীয় ফুলগাছের অপার সম্ভার। রাঙ্গামাটির পাহাড়ি পথে শীত শেষে অর্কিড উৎসব আয়োজন করা যেতে পারে, আর বসন্তে খাগড়াছড়ির বনভূমিকে সাজানো যেতে পারে কাঞ্চনের রঙে, যা হতে পারে আমাদের নিজস্ব ‘চেরি ব্লসম উৎসব'-এর আদলে। এভাবে প্রতিটি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফুলের সৌন্দর্য তুলে ধরে বাংলাদেশকে রূপ দেওয়া যেতে পারে এক ‘ফুলের ক্যালেন্ডার' হিসেবে— যা পর্যটনের সম্ভাবনাময় মঞ্চকে বিস্তৃত করবে । এতে পর্যটন যেমন বছর জুড়ে চলমান থাকবে, তেমনি ফুলের সঙ্গে মানুষের সংযোগ গভীরতর হবে, পরিবেশ সচেতনতা বাড়বে এবং স্থানীয় অর্থনীতিও সচল হবে ।

বিশ্বব্যাপী ফ্লোরাল ট্যুরিজম এখন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ফ্লোরাল ট্যুরিজম বা ফুলভিত্তিক পর্যটন ধারা। নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ বাগান কিংবা জাপানের চেরি ব্লসম উৎসব—সবই নির্দিষ্ট সময়ে লাখ লাখ পর্যটককে আকর্ষণ করে। জাপানের হানামি উৎসব শুধু ফুল দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে থাকে স্থানীয় পণ্যের বাজার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ট্রেন-ভ্রমণ প্যাকেজ এবং ফটো ট্যুর। ফুল ঘিরেই গড়ে উঠেছে একটি সুসংগঠিত পর্যটন অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও ঋতুভিত্তিক ফুলের সম্ভারও এমন একটি কাঠামোর জন্য উপযুক্ত—শুধু প্রয়োজন পরিকল্পনা, প্রচারণা ও বিনিয়োগ ।

এই খাত নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নেরও বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে। মৌসুমভিত্তিক হোমস্টে, ফুল দিয়ে তৈরি হস্তশিল্প, স্থানীয় খাবার এবং সংস্কৃতিভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীরা সক্রিয়ভাবে পর্যটনে যুক্ত হতে পারেন । এর ফলে গড়ে উঠতে পারে একটি কমিউনিটি-ভিত্তিক ট্যুরিজম মডেল, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য উপযোগী।

পরিবেশগত দিক থেকেও ফুলগাছের গুরুত্ব অপরিসীম। শিমুল ও পলাশ ভূমিক্ষয় রোধে সহায়ক, জারুল ও কাঞ্চন ছায়া দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং কার্বন শোষণ করে। এদের ফুলে পরাগায়নকারী মৌমাছি ও কীটপতঙ্গ টিকে থাকে, যা কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফুলগাছ রোপণ, সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু অভিযোজন—সবকিছু একসঙ্গে নিশ্চিত করা যায় ।

এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান ও নীতিগত অগ্রাধিকার। পর্যটন বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ ও স্থানীয় সরকার মিলে একটি জাতীয় ফুলভিত্তিক পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এতে মৌসুমভিত্তিক ট্রেইল, স্থানীয় পণ্যের বাজার, তথ্যকেন্দ্র, পরিবেশ শিক্ষা কর্মসূচি এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ইনকিউবেশন প্ল্যাটফরম অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে । সরকার চাইলে উপজেলা বা অঞ্চলভিত্তিক ‘ফুল পর্যটন অঞ্চল' ঘোষণা করে তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করতে পারে।

পরিশেষে, বাংলাদেশের ফুলগাছ কেবল প্রকৃতির উপহার নয়, এটি মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার অংশ। এখন সময় এসেছে এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করে তা দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের। যথাযথ পরিকল্পনা, সম্মিলিত উদ্যোগ ও সম্প্রসারণমূলক চিন্তা থাকলে বাংলাদেশও একদিন বিশ্বের ফ্লোরাল ট্যুরিজম মানচিত্রে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারবে, যেখানে সৌন্দর্য, পরিবেশ আর মানুষের গল্প একসূত্রে গাঁথা থাকবে ।

লেখক : ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ইসিমোড, নেপাল

মূল লেখাটি ৫ মে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে, লেখাটির লিংক: https://epaper.ittefaq.com.bd/m/434089/681785a427e7f

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram