সমন্বিত পর্বত উন্নয়নের আন্তর্জাতিক সংস্থা
Photo: Jitendra Raj Bajracharya/ICIMOD.

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে এবং টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান

৩০ মে ২০২৪

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতির আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এবারের মত তীব্র তাপপ্রবাহ আগে কখনো অনুভূত হয়নি। এই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ ও দুঃসহ গরম আমাদেরকে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী বছরগুলোতে তাপপ্রবাহ আরও শক্তিশালী হয়ে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এই সমস্যা সমাধানে এবং সর্বোপরি টেকসই উন্নয়নে; প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধান (Nature-Based Solutions: NBS) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান আমাদের নতুন দ্বার খুলে দিতে পারে। এটি একটি কৌশলগত সমাধান যা পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের শক্তিকে কাজে লাগায়।

একটু ভাবুন! বন উজাড় হওয়া স্থানে পুনরায় বনায়ন হয়েছে। উজাড় ভূমিতে স্থানীয় জাতের গাছপালায় ভরে উঠছে। এই পরিবর্তন জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয় রোধ, বাতাস ও পানির গুণগতমান বৃদ্ধি করছে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি স্থানীয় জাতের গাছ কেবল সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করছে না, বরং তাপপ্রবাহ রোধে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করছে। গাছের পাতা, শাখা-প্রশাখা, এবং মাটি রোদের তাপ শোষণের মাধ্যমে পরিবেশকে শীতল করছে। সবুজ কৃষিজমির পাশাপাশি, শিমুল-পলাশের মতো দেশীয় জাতের গাছ ফসলের মাঠে ছায়া ও বায়ু সুরক্ষা প্রদান করছে, তাপের প্রভাব কমিয়ে ফলন বৃদ্ধি করছে।

এবার আরো ভাবুন! সারা দেশের শহরগুলো প্রাণবন্ত সবুজ নাগরিক শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। গাছপালাগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখছে এবং নির্মল ও সজীব বায়ু সরবরাহ করছে। এই মনোরম দৃশ্যগুলো আসলে কল্পনা নয়, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে আমাদের দেশের উন্নয়নকে টেকসই করার কয়েকটি উদাহরণ। একটু মনোযোগ দিলেই এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব।

প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি কার্যকরী পদ্ধতি যা বহুমুখী সুবিধা প্রদান করে। প্রচলিত অবকাঠামোগত সমাধানের তুলনায়, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অনেকাংশে সাশ্রয়ী, কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় এবং অতিরিক্ত পরিবেশগত সুবিধা প্রদান করে।  

আমরা যদি প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান সম্পর্কে আরও সুগভীর চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাব, এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। এইক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জন্য পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি জরুরি ও বড় চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ঝরনা ও ঝিরিকে পানীয় জলের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। তবে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি ও ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। যা, পার্বত্য এলাকায় পানীয় জলের অভাবকে বাড়িয়ে তুলছে। দেখা দিচ্ছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। এমন পরিস্থিতিতে, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান নতুন পথ তৈরি করবে।

উদাহরণস্বরূপ, ঝর্ণার উপরের দিকের বনভূমি ঝর্ণার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঝর্ণার চারপাশে লাগানো স্থানীয় গাছ পানি পরিশোধনে সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া, বনভূমি বৃষ্টির পানি ধরে রাখে এবং ধীরে ধীরে ঝরনায় প্রবাহিত হয়। যা শুষ্ক মৌসুমে জলের প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে। গাছপালা মাটি ধরে রাখে, ভূমির ক্ষয়রোধ করে এবং ঝর্ণায় জমা হওয়া পলির পরিমাণ কমাতে সাহায্য করতে পারে। প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান গ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য সঠিক ও সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামো প্রয়োজন। সরকার, বেসরকারি সংস্থা, রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ এবং স্থানীয় মানুষের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা জরুরি। পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে কার্যকর প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান পদ্ধতি চিহ্নিত করতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের ব্যবহার বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। সেকারণে, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং আমাদের টিকে থাকার জন্য একটি জরুরি প্রয়োজন।

লেখক: কবির উদ্দিন

ভৌগলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ

বাংলাদেশ ফোকাল পারসন, ইসিমোড, নেপাল

 

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram